ডেভিলস ব্রেথ (Devil’s Breath) হলো একটি জাহাজের প্রচলিত নাম। ডেভিলস ব্রেথ একটি লেটিন শব্দ যা “Scopolamine” বা “হাসপাতালি” নামেও পরিচিত।
স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রেথ (Devil’s Breath) কী?
ডেভিলস ব্রেথ (Devil’s Breath) হলো একটি মাদকদ্রব্যের পরিচিতি নাম। এটি স্কোপোলামিন (Scopolamine) নামেও পরিচিত। এটি মূলত ত্রিনেল বিসফলেট নামক একটি উপকারী সাবস্ট্যান্স থেকে তৈরি হয়ে থাকে।
ডেভিলস ব্রেথ হাসপাতাল এবং মেডিকেল ব্যবসায়ে ব্যবহৃত হয় এমন একটি পরিবার্তনশীল উপাদান যা মূলত সিকসমাইন ও হাসপাতালে ব্যবহৃত হয় যাতে মানুষের মন ও শরীরের কিছু রোগের মুক্তির জন্য ব্যবহার করা হয়। এই ড্রাগটির সাথে যুক্ত অন্যান্য উপাদান মিশ্রণ করে অপরিচিত বা টার্গের করা মানুষদের উপর ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যবহারের ফলে অচেতন অনুভব করে এবং টার্গেট করা ব্যক্তিদের নির্দেশনা দেওয়া যায়।
স্কোপোলামিন (Scopolamine) বা ডেভিলস ব্রেথ কী কাজে ব্যবহার করা হয়?
ডেভিলস ব্রেথ একটি মাদকদ্রব্য মানুষের মনের উপর চাপ পড়ে এবং মানুষকে যে কাজটি করতে বলা হয় সে ঐ কাজটি করতে প্রস্তুত থাকে। তার নিজের প্রতি নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যেহেতু এটি মানুষকে পরিচালিত করতে পারে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অনেক মানুষের ক্ষতির কারণ হয়েছে। ডেভিলস ব্রেথ ব্যবহার করে অধিকাংশ ঘটনা অন্যের পরিচালিত নির্দেশ পালন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়, যেমনঃ অপরিচিত ব্যক্তির উপর এটি প্রয়োগ করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া বা কোনো ধর্মকে ছোট করার জন্য অপপ্রচার।
’মানুষকে সম্মোহন করে সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে কেউ’ অথবা আপনি কারো কথামত সবকিছু তার হাতে তুলে দিচ্ছেন কোনরকম প্রতিবাদ না করেই। অনেকটা যাদু-টোনা করার মত অবস্থা। এগুলো শুরুতে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা মনে হলেও ইদানিং যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে আতঙ্কিত হতেই পারেন আপনি। তবে এই ঘটনাগুলোর পেছনে যাদু-টোনা বা তন্ত্রমন্ত্র কিছুই নেই, এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ডেভিলস ব্রেথ (Devil’s Breath) বা শয়তানের নিঃশ্বাস’ নামে পরিচিত একটি ভয়ঙ্কর ড্রাগ স্কোপোলামিন (Scopolamine)।
বাংলাদেশে স্কোপোলামিন (Scopolamine) বা ডেভিলস ব্রেথ
ঢাকা, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রতি সাধারণ মানুষকে লুটে নিতে ব্যবহার করা হচ্ছে স্কোপোলামিন (Scopolamine) নামের এই ভয়ঙ্কর ড্রাগটি। এটির বৈজ্ঞানিক নাম হায়োসিসিন ছাড়াও আরো কয়েকটি নাম রয়েছে যার মধ্যে বুরুন্ডাঙ্গা, কলম্বিয়ান ডেভিলস ব্রেথ, রোবট ড্রাগ, বা জম্বি ড্রাগ উল্লেখযোগ্য।
স্কোপোলামিন আমাদের দেশের জন্য একেবারেই নতুন, ড্রাগটি দেশে ব্যপকহারে ব্যবহার না হলেও যেটুকু ব্যবহার এখন পর্যন্ত হয়েছে তাতে সর্বশান্ত হয়েছে বেশ কিছু মানুষ। ভয়ংকর মাদক ডেভিলস ব্রেথ বা স্কোপোলামিন নিয়ে যে তথ্যগুলো আমি পেয়েছি তা আপনাদের সাথে আজকের লেখায় বিস্তারিত জানাবো।
ধরুন কেউ একজন আপনার কাছে এসে একটি কাগজ বা মোবাইলের মেসেজ দেখিয়ে বলবে ”আন্টি/ভাই/আপু এই ঠিকানাটা কোথায়?” কিংবা কোন এক অসহায় ব্যক্তি একটি প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে বলবে ‘বাবা, এই প্রেসক্রিপশনের ওষুধের নামটা কী? কোথায় পাওয়া যাবে?’ স্বভাবতই আপনি মানবিক বোধ থেকে তাদের সাহায্য করতে যাবেন, আর এখানেই আপনি ফেঁসে গেলেন বা ফাঁদে পা দিলেন।
ইচ্ছা করেই কাগজে লেখাগুলো ছোট করে রাখা হয় যাতে ‘সম্ভাব্য টার্গেট’ মোবাইল বা কাগজটা ভাল করে পড়ার জন্য নাক ও মুখের কাছাকাছি নিয়ে আসতে বাধ্য হয়। তাদের দেওয়া কাগজ, ফোন বা অন্যকিছু আপনি নাক, চোখমুখের কাছাকাছি ধরার সাথে সথে সেখানে লেগে থাকা স্কোপোলামিন আপনার নিঃস্বাসের সাথে গ্রহণ করে ফেললেন। এর পরে আপনার আর কিছুই করার থাকবেনা। আক্রমনটা ব্যাংকের এটিএম বুথের কি-প্যডে লেগে থাকা পাউডার থেকেও হতে পারে।
আপনার মাথা ঝিমঝিম লাগবে এবং আপনি বুঝবেন না আপনি কী করছেন! আপনার নিজের প্রতি কোন নিয়ন্ত্রণ আপনার থাকবেনা। আপনাকে বলা মাত্র আপনি নিজ থেকেই সব করবেন। আপনার কাছে থাকা টাকাপয়সা, গহনা, মোবাইল সহ সব দিয়ে দিবেন আপনার সামনে থাকা ‘ডেভিলস ব্রেথ’ আক্রমণ চক্রের সদস্যের হাতে।
এই ছিনতাইয়ের সাথে নিযুক্ত থাকা আক্রমণ চক্রের সদস্যরা সাধারণত জুয়েলারি দোকান ও ব্যাংকের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে এবং অবস্থাসম্পন্ন নারী পথচারী টার্গেট করে। এই ঘটনা অনেকেই ফেইস করেছেন কিংবা ফেসবুক বা বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে শুনেছেন। অনেকের নিকট আত্বীয়ও এইভাবে সব খুইয়েছেন।
সবার কাছে এটা একটা গোলক ধাঁধাঁ যে এটা আসলে কী? কয়েক মুহুর্তের মধ্যে ‘চিন্তাশক্তি অকার্যকর হয়ে অনেকটা হিপনোটাইজড মত হয়ে যাওয়া এবং ভিকটিমের নিজ থেকেই সব দিয়ে দেওয়া’ কীভাবে সম্ভব?
স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রেথ (Devil’s Breath) কোথায় উৎপত্তি?
স্কোপোলামিন ভয়ংকর একটি ড্রাগ যা মাদক হিসাবে ব্যবহার হয়। উৎপত্তি ল্যাটিন আমেরিকার কলম্বিয়ায় তবে ইকুয়েডর ও ভেনিজুয়েলাতেও এই মাদকটির যথেষ্ট বিস্তার রয়েছে। আপনারা যারা ধুতরা ফুল দেখেছেন তারা এই ফুলটিকেও প্রথম দেখাতে ধুতরা ফুলের সাথে হয়তো মিলিয়ে ফেলতে পারেন। কারণ, আমাদের দেশের যে ধুতরা ফুল পাওয়া যায় এটিও অনেকটা একই রকম দেখতে এবং একই প্রজাতিভুক্ত। ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর স্কোপোলামিন মুলত নাইটশেড পরিবারভুক্ত ফুলের গাছ। একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই গাছের বীজ থেকে তৈরি করা হয় ভয়ংকর ড্রাগটি। ড্রাগটি দেখতে হুবহু কোকেন পাউডারের মতই সাদা তবে এর ক্ষতির মাত্রা কোকেন থেকে বহুগুনে বেশি। মুলত এই ভয়ংকর ব্যাপারটা যুক্ত হয়েছে এর তীব্রতার কারণে। মাত্র ১ গ্রাম স্কোপোলামিন দিয়ে প্রায় এক ডজনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা সম্ভব!
স্কোপোলামিন (Scopolamine) এর শুরুর ব্যবহারঃ
১৯৯০ সালের দিকে এনেস্থেশিয়ার জন্য প্রথম স্কোপোলামিন ব্যবহার শুরু হয়। এনস্থেশিয়ার জন্য প্রথমে এককভাবে স্কোপোলামিন ব্যবহারের প্রস্তাব করা হলেও পরে স্কোপোলামিন এবং মরফিনের সংমিশ্রণে রোগীর শরীরে ব্যবহার করা হয়। মুলত প্রসবেকালীন অ্যামনেসিয়া এবং সিনারজিস্টিক ব্যথা কমানোর জন্য এই ড্রাগটি বছরের পর বছর ব্যবহার করা হতো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইনটারোগেশন সেলে শত্রুপক্ষের আটককৃত সৈন্যদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করার জন্য স্কোপোলামিন ব্যবহার করা হতো। ড্রাগটি ব্যবহারের ফলে ভিকটিমের চিন্তাশক্তির নিয়ন্ত্রণ আর নিজের কাছে থাকে না। ফলে ব্রেন তখন কোন মিথ্যা বলতে পারে না। তবে কতটুকু সত্যি বলে তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাবিভক্তিও রয়েছে কারন এর একুরেসি রেট ৪৪ শতাংশ মাত্র।
ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NASA) তাদের নভোচারীদের মোশন সিকনেস কাটানোর জন্য ০.৩৩ মিলিগ্রাম স্কোপোলামিন ব্যবহার করে। এই ড্রাগটি যদি কোন সাধারণ মানুষের শরীরে ৫ থেকে ৭ মিলিগ্রাম ব্যবহার করা হয় সে তার চিন্তাশক্তির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরুপে হারিয়ে ফেলে জম্বি বা রোবটের মত আচরণ করবে। আর ১০ মিলিগ্রাম স্কোপোলামিন বা তার বেশি পরিমানে কারো শরীরে প্রয়োগ করা হলে সে কোমায় চলে যাবে যেখান থেকে মৃত্যুও ঘটা স্বাভাববিক বিষয়।
ডেভিলস ব্রেথ বা স্কোপোলামিন কিভাবে কাজ করেঃ
স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রেথ শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথে মানুষের মস্তিস্কের প্রাথমিক স্মৃতি বা যাকে বলে ’ইনিশিয়াল স্টেইজ অব মেমোরি’ বলি সেটিকে ব্লক করে দেয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি আক্রমণকারীকে সমনে দেখতে পেলেও চিনতে পারেন না এবং কিছু মনে রাখতে পারে না।
একই সাথে এই ড্রাগটি মস্তিক্ষের চিন্তা করার ক্ষমতাকেও ব্লক করে দেয়। ফলে শরীরে কোন প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না বা বাইরের কোন আক্রমনে শরীর কোন প্রতিক্রিয়া দেখানোর মত অবস্থা থাকেনা। এ অবস্থায় ভিক্টিমের আচরন হয়ে যায় বশীভূত বা সুতায় বাঁধা পুতুলের মত!
স্কোপোলামিন কতক্ষন কার্যকারী থাকতে পারেঃ
চামড়ার মাধ্যমে স্কোপোলামিন দেহে প্রবেশ করালে মাদকটির প্রতিক্রিয়া শরীরে শুরু হতে সাধারণত ২০ মিনিট সময় লাগে এবং তা ৮ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে যিনি স্কোপোলামিন গ্রহণ করলেন তিনি থাকেন গোধুলী ঘুম বা টুইলাইট স্লিপে। আর এই সময়ের মধ্যে তাকে দিয়ে সব কিছুই করানো সম্ভব। ঠিক যেন হিপনোটাইজের ফলে, শরীর ও মনের উপরে সম্পূর্ণ দখল অন্য কারো হাতে চলে যাওয়া। এটা মন ও শরীরকে এতোটাই আচ্ছন্ন করে ফেলে যে, এতে ব্যক্তি নিজের চিন্তা শক্তি হারিয়ে অন্যের কথা মতো কাজ করতে থাকে এমনকি নিজেকে নিজে খুন করার মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটতে পারে অনায়েসেই। কিন্তু যখন এই মাদকের কার্যকরীতা শেষ হয়ে যায় তখন ভিকটিম তার সাথে ঘটে যাওয়া কিছুই মনে করতে পারে না। তাই প্রতিকার পাওয়ারও কোন পথ থাকেনা।
সতর্কতাঃ
এই সময়ে সবথেকে বেশি জরুরী নিজের সাবধানতা, তাই রাস্তাঘাটে অপরিচিত সকলের থেকে সবসময় সতর্ক থাকুন। বিশেষ করে জুয়েলারি ও ব্যাংক থেকে বের হবার সময় নারী ও পুরুষর সকলেই এই ঘটনাগুলো মনে রাখুন এবং সাবধান থাকুন। সাবধান থাকুন রিক্সার যাত্রী ও পথচারী হবার সময়েও।
মাস্ক ব্যবহার করুন। এর সুবিধা হলো দুষ্কৃতিকারীরা আপনাকে সহজে টার্গেট করবে না এবং টার্গেট করলেও মাস্ক আপনাকে প্রটেকশন দিবে এবং সচেতন হলে ততক্ষণে আপনি বুঝে যাবেন যে ‘আপনার সাথে কী হতে যাচ্ছে’!